কোরবানির প্রয়োজনীয় মাসায়ালা সমূহ - জেনে নিন
কোরবানির প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য ওয়াজিব। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সঃ বলেছেন, কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। কিন্তু কোরবানির প্রয়োজনীয় মাসায়ালা সমূহ আমাদের জানা না আমাদের কোরবানি কবুল নাও হতে পারে। তাই কোরবানির প্রয়োজনীয় মাসায়ালা সমূহ জেনে তারপরে কোরবানি করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য একান্ত কর্তব্য।
কোরবানির প্রয়োজনীয় মাসায়ালা সমূহ আমি আমার আর্টিকেলের মাধ্যমে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আপনারা কোরবানির প্রয়োজনীয় মাসায়ালা সমূহ জানতে আমার পোস্টটি শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
কোরবানির প্রয়োজনীয় মাসায়ালা সমূহ
কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এটি আদায় করা ওয়াজিব। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- "কোরবানির দিনের আমলসমূহের মধ্যে পশু কোরবানি করার চেয়ে আর কোন এবাদত আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় নয়। নিশ্চয়ই কিয়ামত দিবসে কোরবানির পশুকে তার শিং, পশম ও খুরসহ উপস্থিত করা হবে। কোরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই তা আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে যায়। অতএব তোমরা আনন্দ-চিত্তে কোরবানি করো"। তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ১৪৯৩।
আরো পড়ুনঃ কোরবানী কি - কোরবানির ইতিহাস জানুন
যে ব্যক্তির আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ইবাদতের উদ্দেশ্যে কোরবানি করে না তার সম্পর্কে হাদিস শরীফে এসেছে - "যার কোরবানির সামর্থ্য আছে কিন্তু কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে"। মোস্তাদেরকে হাকিম, হাদিস নং ৩৫১৯।
কোরবানি তথা ইবাদতের মূল কথা হলো আল্লাহতালার আনুগত্য এবং তার সন্তুষ্টি অর্জন তাই যে কোন ইবাদতের জন্য দুটি জরুরী জিনিস হল -
এখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এবাদত করা।
শরীয়তের নির্দেশনা মোতাবেক সঠিক মাসায়েল জেনে সে অনুযায়ী কার্যসম্পাদন করা।
এছাড়াও কোরবানির কিছু জরুরী মাসায়েল রয়েছে সেগুলো নিম্নে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো -
কার ওপর কোরবানি ওয়াজিব
সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক, মুকিম প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী যিনি ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ ই জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবেন তার ওপরে কোরবানি করা ওয়াজিব।উক্ত মালের ওপর এক বছরের অতিবাহিত হওয়া জরুরি নয়। যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে যেমন ব্যক্তির নিকট তার অর্জিত সম্পদ এক বছর থাকা প্রয়োজন হয়
কিন্তু কোরবানির ক্ষেত্রে এমনটি নিয়ম নয়। এক্ষেত্রে ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ ই জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত যদি তার নিকট নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে তাহলে অবশ্যই তাকে কোরবানি করতে হবে।
কুরবানীর নেসাব
সাদকাতুল ফিতর নিসাব অর্থাৎ যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে যে নেসাব প্রয়োজন হয় কোরবানির ক্ষেত্রেও সেই পরিমাণ নেসাব প্রয়োজন হয় অর্থাৎ যার কাছে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ তোলা রুপা কিংবা সে মূল্যের নগদ অর্থ বা সে মূল্যের প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ঘরবাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা, অন্যান্য সরঞ্জাম আছে তার জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব।
কোরবানির দিন ও সময়
জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল অর্থাৎ আমরা যাকে বলি কোরবানির ঈদ, সেই ঈদের দিন সকালে ঈদের নামাজের পর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কুরবানী করা যায় তবে ১০ তারিখ কোরবানি করা উত্তম। ১২ তারিখ সূর্যাস্তের একটু পূর্বেও যদি কেউ সফর থেকে ঘরে ফিরে আসে অথবা গরিব ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে যায় তবুও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যায়। রাতে কোরবানি করা যায় তবে রাতে কোরবানি করার চেয়ে দিনে কুরবানী করা অধিক উত্তম।
আরো পড়ুনঃ শবে মেরাজ কি ও কেন জেনে নিন
এক্ষেত্রে আপনাকে যদি একান্তই বাধ্য হয়ে রাত্রে কোরবানি করতে হয় সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে মনে রাখতে হবে আপনার লাইটিং ব্যবস্থা যেন অনেক ভাল হয় এবং আপনি যেন সঠিকভাবে কোরবানির পশু কোরবানি করতে পারেন। মনে রাখবেন, কোরবানির পশুর গলার দুই পাশে ও মাঝখানে খাদ্যনালী ও কণ্ঠনালী সহ মোট চারটি রগ আছে। আপনাকে কমপক্ষে তিনটি রগ কাটতে হবে অন্যথায় আপনার কোরবানি হবে না। তাই আপনাকে অবশ্যই আলোর ব্যবস্থা ভালো ভাবে রাখতে হবে।
কোরবানির পশু ও তার বয়স
সঠিকভাবে কোরবানি করতে হলে আপনাকে কোরবানির পশু ও তার বয়স সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে হবে। ছয় প্রকারের হালাল বস্তু দ্বারা কোরবানি করা যায়। যেমন - গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এবং এসব পশুর নর্মাদা উবাহি প্রকার পশু দ্বারা কুরবানী করা যায়। তবে চন্দ্র মাস অনুযায়ী উটের পাঁচ বছর হতে হবে এবং গরু মহিষের ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই বছর পূর্ণ হতে হবে এবং ছাগল, ভেড়া, দুম্বা যদি কোরবানি করেন তাহলে এক্ষেত্রে এদের বয়স কমপক্ষে এক বছর হতে হবে।
দুম্বা যদি এমন মোটাতাজা হয় যে সে দেখতে এক বছরের মতই দেখা যায় তাহলে তা দারাও আপনি কোরবানি করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে আপনাকে মনে রাখতে হবে ছাগলের ক্ষেত্রে এক বছর পূর্ণ হতে একদিন কম হলেও কোরবানি হবে না। বাদায়ের ছানায়ে ৪/ ২০৫ কাজীখানা ৩ /৩৪৮।
দোষ ত্রুটিযুক্ত কোরবানির পশু
কোরবানি একটি এবাদত। তাই আপনাকে এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে আপনি যে পশু দিয়ে কোরবানি দিবেন সে পশু অবশ্যই নিখুত এবং সুন্দর হতে হবে। যদি এমন হয় পশুর দুটি চোখ অন্ধ বা এক চোখ পুরো নষ্ট অথবা যে পশু আপনি কোরবানি করবেন সেই পশুর সিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙে গেছে যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা যে পশু ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারেনা অথবা যে পশু ল্যাংড়া পোড়া হওয়ার কারণে পা মাটিতে রাখতে বা ভর করতে পারে না
আরো পড়ুনঃ লাইলাতুল কদর - ২৭ শে রমজান সম্পর্কে জেনে নিন
অথবা পশু এমন দুর্বল যে জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না অথবা যে পশু কোন না কোন লেজ অর্ধেক বা তার বেশি কাঁটা এমন পশু কোরবানি করা জায়েজ হবে না। বাদায়ে সানায়ে ৪/ ২১৪ থেকে ১৬। এক্ষেত্রে আপনাকে আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে তা হল, যে পশু বন্ধ্যা এবং গর্ভবতী এই পশুর দ্বারাও কোরবানি জায়েজ হবে। ফতোয়ায়ে স্বামী ৬/৩২৫। তবে গর্ভবতী পশু দ্বারা কোরবানি না করাই ভালো।
শরীকানা কোরবানি
আমাদের সমাজে কোরবানি করার ক্ষেত্রে একের অধিক লোক একসঙ্গে শরিকানা ভিত্তিতে কোরবানি দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে কিছু নিয়ম আছে যা আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে আর তা হল ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এই তিন ধরনের পশু একজনই কোরবানি দিতে পারবে। এখানে কোন শরিকানা থাকতে পারবেনা। তার সাথে আর আপনি যদি গরু কোরবানি করেন সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হয়ে একসঙ্গে কোরবানি করতে পারবে।
তবে এক্ষেত্রে শরিকানা কোরবানিতে অবশ্যই সকল অংশীদারের অর্থ হালাল হতে হবে এবং সকলের নিয়ত শুদ্ধ হতে হবে। যে কোন একজনের অর্থ যদি হারাম হয় বা নিয়ত বাতিল হয় তাহলে সকল অংশীদারের কোরবানি নষ্ট হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কোন শরিকের কোরবানি সহিও হবেনা। কোরবানির বড় পশু তথা উট, গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে কেউ যদি কোরবানীর সঙ্গে আকিকার নিয়ত করে আকিকার নিয়তের শরিক হতে পারবে এবং এভাবে কোরবানি ও আকিকা উভয়েই সহিহ হবে।
কোরবানি করার নিয়ম বা জবাই সংক্রান্ত মাসায়েল
কোরবানি করা প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলিমদের প্রতি ওয়াজিব তাই পশু সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আপনাকে ভালোভাবে জানতে হবে। পশু শুধু জবাই দিলেই হবে না, জবাই দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম আছে যা আপনাকে বিস্তারিতভাবে জেনে তারপরে পশু জবাই দিতে হবে বা কোরবানি করতে হবে। যেমন পশুর গলার ২ পাশে এবং মাঝখানে রয়েছে খাদ্যনালী ও কন্ঠনালী এবং এর সাথে রয়েছে মোট চার ৪ টি রগ। এর মধ্যে আপনাকে কমপক্ষে তিনটি রগ কাটতে হবে অন্যথায় পশুটি কোরবানি না হয়ে মৃত বলে গণ্য হবে এবং তার গোস্ত খাওয়া আপনার জন্য জায়েজ হবে না।
আরো পড়ুনঃ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মোট কত রাকাত ফরজ - জানুন
এবং এভাবে পশু জবাই করা মাকরুহ। সবাইকে পশুর দম বের হয়ে ঠান্ডা ও স্থির হয়ে যাওয়ার পর চামড়া ছাড়ানো উচিত। কোরবানির পশু আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করা উচিত তাই জবাইয়ের সময় অবশ্যই আপনাকে বলতে হবে বা এই দোয়াটি পড়তে হবে "বিসমিল্লাহে আল্লাহু আকবার" এবং পশু জবাই করার পর আপনাকে পড়তে হবে "ইন্নি ওয়াজজিহাতু ওয়াজিহালিল্লাজি ফাতারা সামা ওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকিন"।
ঋণ করে কোরবানি দেওয়া যাবে কি?
আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যার সামাজিক একটু পরিচিতি রয়েছে কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা খারাপ কিন্তু তিনি সমাজের মহত্ব বজায় রাখতে কোরবানি দেওয়া উচিত মনে করেন। এ ক্ষেত্রে আপনাকে মনে রাখতে হবে আপনার কাছে যদি নেসাব পরিমাণ অর্থ না থাকে তাহলে আপনার কোরবানি দেওয়া উচিত নয়। এরপরেও যদি আপনি আপনার প্রতিপত্তি ধরে রাখার জন্য কুরবানী দিয়ে থাকেন অর্থাৎ ঋণ করে কোরবানী দেন তাহলে আপনার কোরবানি হয়ে যাবে এবং আপনি সওয়াব পাবেন।
তবে মনে রাখবেন, ঋণ করা কখনোই ভালো নয় কারণ ঋণ হলো এমন একটি হিসাব যা আপনার মৃত্যুর পরে আপনার আত্মা আসমানে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনার ঋণ পরিশোধ হবে আর এ ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার ঋণ করে কোরবানি দেওয়া উচিত নয়, তবে যদি আপনি দেন তাহলে আপনার কোরবানি হয়ে যাবে।
সুদের টাকায় কুরবানী দেওয়া
কোরবানি কখনোই সুদের টাকাতে দেওয়া জায়েজ নেই কারণ সুদ হল একটি গুনাহের কাজ আর এই গুনাহের কাজের টাকা দিয়ে যদি কোরবানি করা হয় তাহলে সেটা তো ইবাদত হবেই না বরং গুনাহের ভাগীদার হতে হবে। কিন্তু কেউ যদি এরপরেও সুদের টাকায় কুরবানী দেয় তাহলে তার জিম্মায় থাকা কোরবানি দায়িত্ব অর্থাৎ ওয়াজিব দায়িত্ব আদায় হবে। এর অর্থ হল তার আর একটি অন্য কোরবানি দেওয়া আবশ্যক নয়।
আরো পড়ুনঃ আশুরার তাৎপর্য আমল ও ফজিলত
যদি সুদের টাকায় কোরবানি দিয়ে থাকে তাহলে তার উচিত উক্ত পশুর সমপরিমাণ হালাল টাকা অন্য সময় দান করে দেয়া। অথবা তাকে প্রথমেই হালাল টাকায় কোরবানি কিনতে হবে তারপরে কোরবানি দিতে হবে।
কোরবানির পশু সহ যে কোন পশুর যে সকল অঙ্গ খাওয়া হারাম
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য কিছু পশু যবেহ করে খাওয়া বা কোরবানি করে খাওয়া হালাল করে দিয়েছেন কিন্তু এইসব পশুর ও বেশ কিছু অঙ্গ রয়েছে যা আমাদের খাওয়া হারাম। যেমন গরু ছাগল মহিষ ভেড়া ইত্যাদি পশুর সাতটি অঙ্গ খাওয়া মুসলিমদের জন্য হারাম। এগুলো হলো -
- পশুর রক্ত
- অন্ডকোষ
- লিঙ্গ
- মূত্রথলী
- পিত্ত
- পায়খানার রাস্তা
- গোল গোল গোশতের চাকা ইত্যাদি।(শামী ৫/৬৫৫,বাদায়েউস সানায়ে ৪/৬১)।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url