আশুরার তাৎপর্য আমল ও ফজিলত
আশুরার তাৎপর্য আমল ও ফজিলত মুসলিম উম্মার কাছে অনেক বেশি। হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর মর্মান্তিক শাহাদত বরণ আশুরাকে আরো গুরুত্বপূর্ণ ও তাপ করে তুলেছে যার কারণে আশুরার তাৎপর্য আমল ও ফজিলত সম্পর্কে জানা একান্ত প্রয়োজন।
প্রিয় সুধী, আমি আপনাদের জন্য আশুরার তাৎপর্য আমল ও ফজিলত যাবতীয় বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। মুসলিম বিশ্বের উম্মার জন্য আশুরার তাৎপর্য আমল ও ফজিলত জানা একান্ত প্রয়োজন। আর আশুরার তাৎপর্য আমল ও ফজিলত সম্পর্কে আমার আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনারা যাবতীয় তথ্য জানতে পারবেন।
আশুরা কি
আশুরা আরবি শব্দ। আরবি মহরম মাসের ১০ তারিখ কে আশুরা বলা হয়। ইসলামের বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস হল মহরম মাস আর এই মহরম মাসের ১০ তারিখে এই পৃথিবীতে সংঘটিত হয়েছে নানান ঘটনা। মহরম মাসের ১০ তারিখ হল আশুরা আর মহরম মাসের অর্থ হলো মর্যাদা পূর্ণ বা তাৎপর্যপূর্ণময়। এই মাসের অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। অন্যান্য মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ করা গেলেও এই মহরম মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ সম্পন্ন রূপে নিষিদ্ধ ছিল যার কারণে এই মাসটি হলো সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ মাস। আর এই মর্যাদার কারণে এই মাসের নামকরণ করা হয়েছে মহরম মাস।
মহরম মাসের ১০ তারিখ অর্থাৎ আশুরার দিন বৃহত্তর শোকের দিন হিসাবে পালিত হয় কারণ এই দিন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নাতি হযরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহার সন্তান হোসাইন ইবনে আলীর মৃত্যুকে স্মরণীয় করে রাখতে আশুরা দিন পালন করা হয়ে থাকে। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কারবালার ময়দানে ইহুদিদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় হযরত হুসাইন ইবনে আলীর শিরচ্ছেদ করা হয়েছিল। মুসলিম সম্প্রদায় আশুরার এই দিন রোজা রাখার মাধ্যমে পালন করে থাকে।
মহরম মাসের রোজার গুরুত্ব
মহরম মাস হল আরবি হিজরি সনের সর্বপ্রথম মাস। বাংলা এবং ইংরেজি যেমন বারটি মাস নিয়ে একটি বছর গঠিত হয় আরবিতেও ঠিক তেমনি বারো মাস নিয়ে আরবি বছর গণনা করা হয়। আর মহরম মাস হল আরবি বছরের প্রথম মাস। মহান আল্লাহতালা আরবি মাসগুলোর মধ্যে চারটি মাসকে সম্মানিত করেছেন এগুলো হলো - মহরম, জিলকদ, জিলহজ ও সফর মাস। তবে মহরম মাস হলো সর্বোচ্চ সম্মানিত। মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র আল কোরআনের সূরা আত্ তাওবাহর ৩৬ নং আয়াতে বলেছেন" যেদিন থেকে আমি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছি সেদিন থেকে নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে গণনা হিসাবের মধ্যে মাস হল বারটি। এর মধ্যে চারটি মাস বিশেষ সম্মানিত"।
রমজান মাসের রোজা হল ফরজ আর রমজান মাস ছাড়া বছরের আরও ১১ টি মাস রয়েছে যে মাসে রোজা রাখা নফল। তবে যত নফল রোজা রয়েছে ফজিলতের বিবেচনায় মহরম মাসের রোজা বা আশুরার রোজা অর্থাৎ মহরম মাসের ৯-১০ অথবা ১০ -১১ তারিখের রোজা হল সবচেয়ে বেশি ফজিলত পূর্ণ। সহিহ বুখারীর ১৮৬৫ নং হাদিস থেকে জানা যায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন " মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদীনায় এসে দেখতে পেলেন ইহুদীরা আশুরার দিন রোজা পালন করে নবী সালাম বললেন এটা কি!
আরো পড়ুনঃ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মোট কত রাকাত ফরজ - জানুন
তারা বলল, এটি একটি ভালো দিন। এ দিনে আল্লাহতালা বনি ইসরাইলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে বাঁচিয়েছিলেন তাই মুসা (আঃ) এই দিনে রোজা পালন করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বললেন, মূসা (আঃ) কে অনুসরণ করার ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। অতঃপর তিনি রোজা রেখেছেন এবং রোজা পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন"। সহীহ বুখারীর ১/২১৮ নং আর এক হাদিসে জানা যায়, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন" আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামকে রমজান মাস ও আশুরা মাসে যে রূপ গুরুত্তের
সাথে রোজা পালন করতে দেখেছি অন্য কোন সময় তা দেখিনি"। এছাড়াও মুসলিম ২/৩৬৮ হাদিস নং জামে তিরমিজি হাদিস নং ১/১৫৭ নং হাদিস মারফত জানা যায় আবু হুরায়রা রাঃ বলেন, "রাসূল (সাঃ) বলেন" রমজানের পর আল্লাহর মাস মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ"। সহীহ বুখারীর ১৮৭৫ নং হাদিসে জানা যায়, হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন," রাসূল (সাঃ) প্রথমে আশুরার দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে যখন রমজান মাসে রোজা ফরজ করা হলো তখন যার ইচ্ছা আশুরার রোজা পালন করতো আর যার ইচ্ছা পালন করত না"।
সূনানে নাশাঈ হাদিস নাম্বার ২৪১৮ থেকে জানা যায় হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন," রাসূল (সাঃ) চারটি আমল কখনোই পরিত্যাগ করতেন না এগুলো হলো - আশুরার দিনের রোজা, জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখের রোজা, প্রত্যেক মাসের ১৩-১৪-১৫ অর্থাৎ আওয়াবিন বীজের রোজা এবং ফরজ নামাজের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ"। উপরোক্ত হাদিস থেকে জানা যায় আশুরার রোজা অর্থাৎ মহরম মাসের দুইটি রোজা নফল হলেও অন্যান্য নফল রোজার তুলনায় অধিক মর্যাদাপূর্ণ।
আশুরার রোজা দুই ২ টি হওয়ার কারণ
অন্যান্য নফল রোজার মতো আশুরার নকল রোজা একটি রাখা যায় না, এক্ষেত্রে দুই ২ টি রোজা রাখতে হয় আর এর প্রধান কারণ হলো আমাদের প্রিয় নবীর রাসূল (সাঃ) মুসনাদে আহমদ এর ১/২৪১ নং হাদিসের বলেন" তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে রোজা রাখো, আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখো"। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত, সহীহ মুসলিম ১/৩৭৯ নং হাদিস থেকে জানা যায় " রাসূল (সাঃ) বলেন, আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে নয় ৯ তারিখেও অবশ্যই রোজা রাখব" এ থেকে বোঝা যায় আশুরার রোজা একটি নয় দুইটি।
আশুরার রোজার বিশেষ দুটি পুরস্কার
ইসলামে মহরম মাসের ১০ তারিখে আশুরা হিসেবে অভিহিত করা হয় কারণ এই দিন ঘটে গিয়েছিল ইসলামের ইতিহাসে অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নাতি হযরত হুসাইন ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে এই দিন শিরচ্ছেদ করা হয় এবং তিনি কারবালার প্রান্তরে শহীদ হন। আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে মহরম মাসের রোজার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন কিন্তু এই দিন অর্থাৎ আশুরার দিন মদিনার ইহুদিরা একটি রোজা পালন করে।
আর আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) তাদের থেকে একটু আলাদা করার জন্য বলেছেন তোমরা মদিনার ইহুদিদের সাদৃশ্য হয়ো না, তোমরা দুইটি রোজা করবে আর তা হলো মহররমের দিন এবং তার আগের দিন অথবা পরের দিন অর্থাৎ মহরম মাসের ৯-১০ তারিখ অথবা ১০- ১১ তারিখ এই দুই দিন রোজা রাখার কথা বলেছেন। তিরমিজি শরীফের ১ / ১৫৭ নং হাদিস মারফত জানা যায়, একবার হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু মুহাম্মদ (সাঃ) কে প্রশ্ন করেছিলেন
আরো পড়ুনঃ কোন নামাজ কয় রাকাত - বিস্তারিত জেনে নিন
রমজান মাসের পর এমন কোন মাস আছে কি যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার ব্যাপারে আদেশ করেন। তখন রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও তবে মহরম মাসে রাখো, কারণ এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে যে দিনে মহান আল্লাহতালা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতে ও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।
আর এই মহরম মাসের দুইটি রোজা অর্থাৎ আশুরার রোজা সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম বলেন," আমি আশাবাদী যে আশুরার রোজা রাখলে মহান আল্লাহতালা অতীতের এক বছরের সগিরা গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন" সহি ও মুসলিম হাদিস নং ১/৩৬৭ জামে তিরমিজি হাদিস নং ১/১৫৮। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর এই কথা থেকে জানা যায় যে আশুরার দিনের দুইটি বিশেষ পুরস্কার হল -
আল্লাহতালা একটি জাতি এবং অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন এবং
অতীতের এক বছরের সগিরা গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।
আশুরার দিনের আমল
আশুরার দিন বা মহরম মাসের ১০ তারিখের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হল রোজা পালন করা কারণ এই দিনে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) রোজা পালন করতেন। আমাদের প্রিয় নবী হিজরতের পর মদিনায় এসে দেখতে পেলেন মদিনার ইহুদিরা এই দিনের রোজা পালন করে। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এই দিনে রোজা পালন করো কেন! তখন ইহুদীরা তাদের জবাবে বলল, এটা একটি ভালো দিন। এই দিনে আল্লাহ বনি ইসরাইলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে বাঁচিয়েছিলেন।
তাই মুসা আঃ এই দিনে রোজা পালন করেছেন। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন মুসা আঃ কে অনুসরণ করার ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। অতঃপর তিনি মহরম মাসের ১০ তারিখে রোজা পালন করতেন কিন্তু ইহুদিরা যেহেতু শুধু ১০ তারিখে রোজা পালন করত তাই আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ বলেছেন, তোমরা ইহুদিদের সাদৃশ্য হয়ো না। তোমরা মহরম মাসের ৯-১০ অথবা ১০-১১ এই দুই দিন মিলিয়ে দুইটি রোজা করবে।
আরো পড়ুনঃ লাইলাতুল কদর - ২৭ শে রমজান সম্পর্কে জেনে নিন
আর এই রোজার ব্যাপারে আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী আল্লাহ তায়ালা এর উসিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন এবং এই দিনে তিনি তওবা কবুল করবেন। তাই আশুরার দিনে শুধু রোজা ছাড়া তেমন কোন ইবাদতের কথা বলা নেই। এমনি অন্যান্য সাধারণ দিনের মতো ইবাদত বন্দেগী করতে হবে এবং অতিরিক্ত হিসাবে মহরমের দিন এবং তার আগের দিন অথবা পরের দিন মিলিয়ে মোট দুইটি রোজা পালন করতে হবে।
মিশকাত শরীফের ১৭০ নং হাদিস, ফয়েজুল কালাম এর ৫০১ নাম্বার হাদিস এবং বায়হাকী ও রাজিন এর ৩৭৯ নাম্বার হাদিস থেকে জানা যায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বর্ণনা করেন " রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলেছেন আশুরার দিনে যে ব্যক্তি তার পরিবারের জন্য ব্যয় বৃদ্ধি করবে, ভালো খাবারের ব্যবস্থা করবে আল্লাহ তাআলা তার সারা বছরের জন্য প্রাচুর্য বাড়িয়ে দিবেন"।
আশুরার দিনের ঘটনা বা কারবালার ঘটনা
কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মহররম মাসের ১০ তারিখে। হযরত মুয়াবিয়া রাজিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু খলিফা হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন ২০ বছর এবং তিনি হিজরী ষাট৬০ সালে ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালের পর অবৈধভাবে ইয়াজিদ ক্ষমতা দখল করে আর ইয়াজিদ ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক। মদ পান, নিষ্ঠুরতা এমন কোন বদ অভ্যাস ছিল না যেটা তার মধ্যে ছিল না। ইয়াজিদের আচরণে মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
ইয়াজিদ তার উত্তরাধিকার পাওয়ার পরে মদিনার সকল লোকসহ হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু আরও কয়েকজনকে তার আনুগত্য স্বীকার করার জন্য বাধ্য করার নির্দেশ দেন কিন্তু হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তা অস্বীকার করেন। কারণ তিনি অর্থাৎ ইয়াজিদ ইসলাম এর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন এবং মুহাম্মদ সাঃ এর সুন্নাহ পরিবর্তন করেছেন যার কারণে হযরত হোসাইন, তার ছেলে ও তার ভাই হাসানের ছেলেদের সাথে মক্কায় আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য মদিনা ত্যাগ করেন।
কিন্তু মদিনা ও কুফার লোকজন হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে সেখানকার খলিফা হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন এবং তারা হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে একটি পত্র প্রেরণ করেন আর এই পথের মাধ্যমে তারা দাবি করেন যে, সুন্নাহ পুনর্জীবিত এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য অবিলম্বে তাকে দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু ইয়াজিদের ব্যবহার এতই খারাপ ছিল যে তার ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়েই হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু মক্কা-মদিনায় অবস্থান করছিলেন।
আরো পড়ুনঃ শবে মেরাজ কি ও কেন জেনে নিন
মদিনায় অবস্থারত সাহাবীরা এবং তার আপনজন হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কে এ সময় কুফায় যেতে নিষেধ করেন। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলেন ইয়াজিদের পক্ষ থেকে যদি কোনরকম আক্রমণ করা হয় তাহলে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর পক্ষে তেমন কোন লোক থাকবে না সবাই দল ত্যাগ করবে।হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কুফা বাসীর ডাকে সাড়া দিয়ে তার চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় পাঠানো হয়।
সেখানকার সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য আর তাকে বলে দেওয়া হয় যে, সেখানকার পরিস্থিতি যদি অনুকূলে দেখা যায় এবং ইরাক বাহির অন্তর ও সুসংহত হয় তাহলে যেন হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর কাছে দূত পাঠানো হয়। মুসলিম ইবনে আকিল যখন কোথায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে ১৮ হাজার প্রবাসী আসে এবং হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর পক্ষে বায়াত বহন করে এবং তারা শপথ করেন যে তারা সবাই জানমাল দিয়ে ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কে সার্বিক দিক থেকে সহযোগিতা করবে।
কুফার এই পরিস্থিতি দেখে হযরত মুসলিম ইবনে আকিল হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কে খবর পাঠান যে, কুফার পরিস্থিতি সন্তোষজনক এবং তিনি যেন এখানে আগমন করেন। হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কুফা বাসীর সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে জিলহজ্ব মাসের ৮ তারিখে ১৯ জন সদস্য সহ প্রায় ২০০জন অনুচর নিয়ে রওনা হন কুফার উদ্দেশ্যে। ইয়াজিদ হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কোপা আগমনের খবর শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়েন
এবং তখনকার কুফার গভর্নর নোমান ইবনে বশির রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহুকে পদচ্যুত করেন এবং হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যেন কোনোভাবেই কুফায় পৌছাতে না পারে সেজন্য সেখানে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে দায়িত্ব প্রদান করেন। ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরেই মুসলিম বিন আকিলকে হত্যা করেন এবং হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যেন কুফায় পৌঁছাতে না পারে সেজন্য চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করে।
কিন্তু হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যখন মক্কায় পৌঁছেন তখন তিনি জানতে পারেন যে, ইয়াজিদ হজের সময় তাকে হত্যা করার জন্য মদিনাতে ঘাতক পাঠিয়েছে। হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যখন এই ঘটনা জানতে পারেন তখন তিনি পবিত্র কাবা শহর ও কাবার পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য তিনি হজ পরিত্যাগ করেন এবং সেখানকার পরিস্থিতি যেন প্রতিকূলে আসে সেজন্য তিনি তার সঙ্গীদের কুফায় যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন।
যাওয়ার পর দেখতে পান সেখানে বিখ্যাত সাহাবী মুসলিম ইবনে আকিল নিহত হয়েছেন এবং ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিহাদের সেনাবাহিনীর মধ্যে কিছু শূন্যবাহিনীর তিনি মুখোমুখি হয়েছেন। হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তার পরিবার ও সঙ্গীদের নিয়ে যখন ফোরাত নদীর তীরে অর্থাৎ কারবালার প্রান্তরে পৌছালেন তখন ইবনে জিয়াদের সৈন্য বাহিনী তাদের অবরোধ করে ফেলল এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ তারা বন্ধ করে দিল। যার কারনে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর শিবিরে পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়ে গেল।
হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এমন অবস্থা দেখে কুফা বাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করেন এবং তিনি বলেন-" আমি কোন যুদ্ধ করতে আসিনি এমনকি আমি কোন ক্ষমতার দখলের জন্য আসিনি। তোমরা আমাকে দেডেছ তাই আমি এসেছি। এখন তোমরা কুফাবাসী তোমরাই আমার বায়াত পরিত্যাগ করছো! তাহলে তোমরা আমাদের যেতে দাও, আমরা মদিনায় ফিরে যায় অথবা আমরা কাফেরদের সঙ্গে সীমান্তের যুদ্ধ করি অথবা আমরা বোঝাপড়া করি ইয়াজিদের সঙ্গে"।
ইবনে জায়েদ হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু আত্মসমর্পণের জন্য আদেশ দেন কিন্তু হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ঘৃণা ভোরে এই আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন ইতিহাসে স্মরণীয় সেই মহরমের ১০ তারিখ সকালে ইয়াজি দ তার নেতৃত্বে প্রায় চার হাজার সৈন্য বাহিনী নিয়ে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বীরত্বের সাথে তার সঙ্গীদের নিয়ে জিহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে।
আরো পড়ুনঃ কসর নামাজ কি - বিবাহিত মেয়েদের বাবার বাড়িতে নামাজ পড়ার বিধান জেনে নিন
এই যুদ্ধে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর পরিবারের একমাত্র সন্তান জয়নুল ছাড়া প্রায় সবাই শাহাদত বরণ করেন।হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বীরত্বের সাথে লড়াই চালিয়ে যান কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই কাফের মুনাফিকের দল অত্যন্ত নির্মম ও নির্দয়ভাবে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হত্যা করেন এই সীমার পাপিষ্ঠরা হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর শরীর থেকে তার মস্তক আলাদা করে ফেলেন অর্থাৎ শীরচ্ছে করে।
পাপিষ্ট ইয়াজিদের দল হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কে এত নির্মমভাবে হত্যা করেছিল যে তার মৃত্যুর পরে তার দেহ মোবারক থেকে ৩৪ টি তরবারির আঘাত এবং ৩৩ টি বর্ষার চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়াও তার শরীরে ছিল অসংখ্য তীরের যখমের চিহ্ন। হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কারবালার প্রান্তরে শাহাদত বরণ করার মাধ্যমে প্রমাণ করে গেছেন সত্য মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, হোক ও বাতিল কখনোই একত্র হতে পারে না। সত্যের বিষয়ে কখনো ছাড় নেই, প্রয়োজনে শহীদ হতে হবে।
আশুরার দিনে কি কি ঘটনা ঘটেছে?
- মহরম মাসের ১০ তারিখে পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়।
- এই দিনে হযরত আদম আঃ কে সৃষ্টি করা হয় এবং তাকে জীবন দান করা হয়।
- হযরত আদম আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়।
- হযরত আদম আঃ মাসের ১০ কে মহরম তারিখে পৃথিবীতে অবতরণ করানো হয়।
- হযরত নূহ আঃ এর সময় মহরম মাসের ১০ তারিখে বন্যা শুরু হয় ফলে নূহ আঃ নৌকায় যাত্রা করেন।
- মহররম মাসের দশ তারিখে বন্যার সমাপ্তি ঘটে।
- হযরত ইব্রাহিম আঃ নমরুদের অগ্নিকুণ্ডু থেকে মুক্তি পান।
- হযরত দাউদ আঃ জালুদ বাহিনীর উপর বিজয় লাভ করেন।
- হযরত আইয়ুব আলাই সালাম ১৮ বছর অসুস্থতার পর রোগ মুক্তি লাভ করেন
- হযরত ঈসা আঃ কে আসমানে তুলে নেওয়া হয়।
- এই দিনে হযরত মুসা আঃ সিনাই পর্বতে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত লাভ করেন।
- এই দিনে বনি ইসরাইল ফেরাউনের কয়েদ খানা থেকে উদ্ধার লাভ করেন।
- ১০ তারিখে হযরত ইউনুস আঃ মাছের পেট থেকে উদ্ধার পান।
- হযরত আইয়ুব আঃ দীর্ঘ ১৮ বছর দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভোগার পর এই দিনে মুক্তি লাভ করেন।
- হযরত সুলাইমান আঃ এই পৃথিবীতে একচ্ছত্র রাজত্বের অধিকারী হন।
- হযরত দাউদ আঃ কে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয়।
- গজ ওয়ানে খাইবার বিজয় হয়।
- কাঁদিসিয়া ও মাদায়েনের যুদ্ধে বিজয় অর্জন হয়।
- হযরত ইয়াকুব আঃ তার হারানো পুত্র হযরত ইউসুফ আঃ এর সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ করেন।
- মহরম মাসের দশ তারিখে ফেরাউন লোহিত সাগরে ডুবে মারা যায়।
- আমাদের প্রিয় নবী এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর নাতি হযরত ইমাম হুসাইন রাজিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তার ৭৭ জন ঘনিষ্ঠ সঙ্গীসহ ইয়াজিদের সেনার হাতে কারবালার ময়দানে শহীদ হন।
কারবালা কি জন্য বিখ্যাত?
কারবালা হলো মক্কার একটি প্রসিদ্ধ শহর। কারবালার নাম শুনলে মুসলিম উম্মার মনে একটি বেদনা কথা স্মরণ হয়ে যায়। কিন্তু কারবালা বেশি সুপরিচিত হয়েছে ঐতিহাসিক কারবালার যুদ্ধের কারণে যেখানে আমাদের প্রিয় এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর নাতি হযরত আলী ও ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর পুত্র হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু শাহাদত বরণ করেন। যার কারনে শিয়া মুসলমানেরা মক্কা, মদিনা ও জেরুজালেমের পর কারবালাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান হিসেবে স্থান দিয়ে থাকে।
মানুষ কেন কারবালায় যায়?
কারবালা হল মক্কার একটি প্রসিদ্ধ শহর এবং এই শহরের নাম শুনলে মুসলিম উম্মার মনে বেদনার উদ্বেগ হয়। আর এর প্রধান কারণ হলো এখানে আমাদের প্রিয় এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর নাতি এবং হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ও ফাতেমা রাদি-আল্লাহু তা'আলা আনহুর পুত্র হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু শাহাদত বরণ করেন। আর এই শাহাদত বরণের পর থেকেই এই কারবালার ময়দান আলীর মাজারের তীর্থ যাত্রা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যার কারণে প্রতিবছর সাফারের ২০ তারিখ অর্থাৎ আরবাইন নামেও পরিচিত এখানে লক্ষ লক্ষ তীর্থ যাত্রী ছুটে আসেন এবং এখানে উল্লেখ আছে কারবালার এই তীর্থ স্থানে সেখানের শিয়া মুসলিমগণ নাজাফ শহর থেকে পায়ে হেঁটে আসেন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url