কোরবানি কি ফরজ - কোরবানি কার উপর ওয়াজিব জেনে নিন
কোরবানি প্রতিটি সামর্থ্যবান এবং ঈমানদার মুসলমানের জন্য অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য। মহান আল্লাহতালার সন্তুষ্টির জন্য জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখে হলাল পশু জবাই করা হয় আর একেই কোরবানি বলা হয়। আর কোরবানির মাধ্যমে মহান আল্লাহতালার সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব।
পোস্ট সূচিপত্রঃ কোরবানি কি ফরজ - কোরবানি কার উপর ওয়াজিব
- কোরবানি কি ফরজ
- কোরবানি কার ওপর ওয়াজিব
- কোরবানির বিধান
- কোরবানির পশু বন্টন
- মহিলাদের কোরবানি করা
- কোরবানির শর্তাবলী
- শেষ কথা
কোরবানি কি ফরজ
ইসলাম ধর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো কোরবানি। প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম লাইস, ইমাম আউজায়ি, ইমাম আহমদ, ইমাম মালেক প্রমুখদের মতে কোরবানি ওয়াজিব। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমের সূরা কাওসারের দুই নং আয়াতে বলেছেন, "তোমরা প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কোরবানি করো"। আর মহান আল্লাহতালার নির্দেশ পালন করা ওয়াজিব।
রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়ালাহিস সাল্লাম বলেন, "যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে কাছে না আসে"। (মোশনাদে আহমদ হাকেম ইবনে মাজাহ)। যারা কোরবানি পরিত্যাগ করে তাদের জন্য এ হাদীসটি হল একটি সতর্ক বাণী স্বরূপ। আর এ হাদিস থেকে বোঝা যায় কোরবানি করা ওয়াজিব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "হে মানব সকল প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হল প্রতিবছর কোরবানী দেওয়া" (মোশনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ)।
কোরবানির সম্পর্কে দ্বিতীয় মত
ইমাম শাফি ও ইমাম মালেকের মত হল কোরবানি সুন্নতে মুয়াক্কাদা। আবার অধিকাংশ আলেমদের মত কোরবানি সুন্নতে মুয়াক্কাদা। আবার এ-মতের দ্বারা প্রবক্তা তারা আবার বলেছেন সামর্থ্য থাকা অবস্থায় কোরবানী পরিত্যাগ করা বা সামর্থ্য থাকা সত্বেও যদি কোন জনপদে লোকেরা কোরবানী পরিত্যাগ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কারণ ইসলামের মহান নিদর্শন হলো কোরবানি।
আরো পড়ুনঃ শুক্রবারে - বা জুমার দিনের - অতি গুরুত্বপূর্ণ ১১ টি বিশেষ আমল সম্পর্কে জেনে নিন
রাসুল সাঃ বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে যে কোরবানি করতে চাই জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কোরবানি সম্পন্ন করার আগে চুলও নক না কাটে"। (মুসলিম হাদিস ১৯৭৭)। আর এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ আলেমগণ মনে করেন কোরবানি ওয়াজিব নয়। রাসুল সাঃ বলেছেন "যে কোরবানি করতে চায়" এখানে বাধ্যবাধকতা নেই।উম্মতের মাঝে যারা কোরবানি করেনি তাদের পক্ষ থেকে রাসূল সাল্লাহু সাঃ কোরবানি করেছেন আর এ থেকে বোঝা যায় যে কোরবানি ওয়াজিব নয়।
কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার পক্ষে মতামত
আমরা সবাই কোরবানি করি কিন্তু কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার পক্ষে যে মতামত রয়েছে তা আমরা জানি না। তাই কোরবানি দেওয়ার পূর্বে আমাদের এই সকল বিষয় সম্পর্কে অবশ্যই জানতে হবে।কোরবানি ওয়াজিব এই মত টি সঠিক কারণ মহান আল্লাহতালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম কে কোরবানি পেশ করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সতর্ক বাণী পেশ করেছেন।
কোরবানি সুন্নত হওয়ার ব্যাপারে মতামত
কোরবানির সুন্নত হওয়ার ব্যাপারে দুইটি দলিল পেশ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে রাসুল সাঃ বলেছেন, তোমাদের মাঝে যে কোরবানি করতে চায় আর এই কথা তারা বোঝা যায় কোরবানির বিধান বর্ণনা করা এই হাদিসের মূল উদ্দেশ্য নয় বরং এই কথার মূল উদ্দেশ্য হলো জিলহজ্ব মাসের শুরু থেকে কোরবানি সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট আমলের কথা বলা হয়েছে। আর এর দ্বারা বোঝা যায় যে কোরবানি করবে সে যেন আমল গুলো সঠিকভাবে পালন করে।
আরো পড়ুনঃ হজ কাকে বলে - হজ কত প্রকার ও কি কি জেনে নিন
আবার দ্বিতীয় হাদিসে বলা হয়েছে রাসূল সাঃ এর উম্মতের মধ্যে যাদের সামর্থ্য নেই তাদের পক্ষ থেকে রাসুল সাঃ কোরবানি করেছেন। আর এই দলিলে এটাই প্রমাণিত হয় যে যাদের সামর্থ্য নেই তাদের ওপর কোরবানির কোন নির্দেশ নেই যার সামর্থ্য আছে কোরবানি তার ওপর ওয়াজিব। তাই যাদের সামর্থ্য আছে তারা যেন অবশ্যই কোরবানি করে কারণ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি না করলে রাসূল সাঃ ঈদগাহে যেতে নিষেধ করেছেন।
কোরবানি কার ওপর ওয়াজিব
ইসলামী শরীয়া মোতাবেক কোরবানির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর কোরবানি করা ওয়াজিব। যে ব্যক্তির সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানী করে না তার জন্য রয়েছে কঠিন তিরস্কার। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "যার সামর্থ্য থাকা শর্তেও কোরবানি করে না সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে"।( আত তারগীব, ২/ ৫৫)।
প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নারী যে ১০ জিলহজ্জ থেকে ১২ জিলহজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত তার সংসারের খরচ মিটিয়ে প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদের কোরবানি তার ওপর ওয়াজিব। যাকাতের মত কোরবানির হিসাব ও করা হয়। যেমন সোনা - রুপা, টাকা-পয়সা,ব্যবসা এবং খোরাকের প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, সাংসারিক পণ্য,প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্যসহ সকল প্রকার সামগ্রিকে ধরা হয়।
আরো পড়ুনঃ সালাত কাকে বলে - সালাতের উপকারিতা সম্পর্কে জানুন
যেমন - সোনা সাড়ে সাত ভরি, রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে ৫২ তোলা, টাকা, পয়সা অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে সোনা বা রুপার মূল্যের সমান হয়ে যায় তাহলে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব।( আল মুহিদুল বোরহানি খন্ড ৮ হাদিস নাম্বার ৪৫৫, যাকাত আরওয়া তাতার খনিয়া ১৭/৪০৫)।
দরিদ্র ব্যক্তির উপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয় তবে সে যদি কোরবানির নিয়তে কোন পশু কিনে তাহলে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।বাদায়েউস সানায়ে,৪/ ১৯২। অর্থাৎ ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ মাগরিব পর্যন্ত যে নিশাব পরিমাণ টাকার মালিক হবেন তার জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব। তবে যাকাতের মত নেশাব পরিমাণ অর্থ তার কাছে এক বছর থাকা জরুরি নয়।
কোরবানির বিধান
মোহাম্মদ ইবনে বাশশার বারারা থেকে বর্ণিত, "রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন আমাদের এদিনে আমরা সর্বপ্রথম যে কাজটি করব তা হল সালাত আদায় করব এরপর ফিরে এসে আমরা কুরবানী করব। যে ব্যক্তি এভাবে তা আদায় করল সে আমাদের নীতি অনুসরণ করল। আর যে ব্যক্তি আগে জবাই করল তা এমন গোসত রূপে গণ্য হবে যা সে তার পরিবার পরিজনের জন্য আগাম ব্যবস্থা করল।
এটা কিছুতেই কুরবানি বলে গণ্য হবে না। তখন আবু বুরুদা ইবনে নিয়ার দাঁড়ালেন আর তিনি সালাতের আগেই জবাই করেছিলেন। তিনি বললেন আমার নিকট একটি বকরির বাচ্চা আছে নবী সাঃ বললেন, তাই জবাই কর। তবে তোমার পরে আর কারো পক্ষে তা যথেষ্ট হবে না।
আরো পড়ুনঃ রোজা কাকে বলে - রোজা ভঙ্গের কারণ জেনে নিন
কোরবানির পশু বন্টন
মহিলাদের কোরবানি করা
হযরত আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, "নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে প্রবেশ করলেন।অথচ মক্কা প্রবেশ করার পূর্বে তার মাসিক শুরু হয়েছিল তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তোমার কি হয়েছে? মাসিক শুরু হয়েছে নাকি? তিনি বললেন হ্যাঁ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন, এটা তো এমন এক বিষয় যা আল্লাহ তাআলা আদম আ: সালাম এর কন্যা সন্তানের ওপর বিধান করে দিয়েছেন।
আরো পড়ুনঃ নারীদের ওপর কখন হজ ফরজ হয় - নারীদের হজ পালন করার শর্ত জেনে নিন
সুতরাং তুমি আদায় করে যাও হাজীগঞ্জ যা করে থাকে। তুমি অনুরূপ করে যাও। তবে তুমি বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করবে না। এরপর আমরা যখন মিনায় ছিলাম তখন আমার কাছে গরুর গোশত নিয়ে আসা হলো আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি? লোকজন উত্তর করল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তার স্ত্রীর পক্ষ থেকে গরু কোরবানি করেছেন"।
কোরবানির শর্তাবলী
নির্ধারণ করে দিয়েছে এমন পশু দিয়ে কোরবানি দিতে হবে সেগুলো হল - উট, গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, মহিষ ইত্যাদি এগুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় রাহিমাতুল আনআম। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, "আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি। তিনি তাদেরকে জীবন উপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে"।
জাবের রহমাতুল্লাহ আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম বলেন, "তোমরা অবশ্যই এক বছরের বয়সের ছাগল কোরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ শাবক কোরবানি করতে পারো"।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উট, গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, মহিষ এগুলো ছাড়া কোন জন্তু কোরবানি করেননি এবং কোরবানি করতেও বলেননি তাই কোরবানি শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে। ইমাম মালিক রহমতুল্লাহ এর মতে, কুরবানির জন্য সর্বোত্তম পশু হলো শিংওয়ালা সাদা কালো দুম্বা। কারণ রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম এ ধরনের দুম্বা কোরবানি করেছেন বলে মুসলিম ও বুখারী হাদিসে এসেছে।
আরো পড়ুনঃ আখেরি চাহার সোম্বা কি এবং কেন জেনে নিন
জাবের রহমাতুল্লাহ আনহা থেকে বর্ণিত, "আমরা হুদাইবিয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম এর সাথে ছিলাম। তখন আমরা উঠো গরু দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কোরবানি দিয়েছি"।
তবে কোরবানির পশু অবশ্যই হৃষ্ট পুষ্ট অধিক মাংস সম্পন্ন নিখুত এবং সুন্দর হতে হবে। এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে কুরবানীর পশুর বয়সের দিকটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। উট হলে পাঁচ বছর বয়স হতে হবে, গরু বা মহীর দু'বছর বয়স হতে হবে এবং ছাগল ভেড়া হতে হবে এক বছর বয়সের।
সাহাবী আল বারাই ইবনে আজিম রহমতউল্লা আনহা থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন চার ধরনের পশু যা দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে না অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে পরিপূর্ণ হবে না। যেমন -
অন্ধ -, যার অন্ধত্ব স্পষ্ট।
রোগাক্রান্ত - যার রোগ ইস্পষ্ট
পঙ্গু - যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং
আহত - যার কোন অঙ্গ ভেঙ্গে গেছে
শেষ কথা
কোরবানি করা প্রত্যেকটি সামর্থ্যবান নর-নারীর উপর ওয়াজিব। কোরবানি করার ব্যাপারে কঠিন নির্দেশনা রয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন সামর্থ্য থাকা সত্তে যে কোরবানি করেনা সে যেন আমার ঈদগাহের ধারে কাছে না আসে। আর এ কথা থেকে আমরা বুঝতে পারি কোরবানি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই যারা কোরবানির ব্যাপারে শীতলতা মনে করেন তাদের ধারণা ভুল।
আরো পড়ুনঃ হায়েজ কি - হায়েজ অবস্থায় নামাজ - কোরআন পড়ার বিধান জেনে নিন
আমি কোরবানির সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আশা করি আমার এই তথ্য
আপনাদের অনেক উপকারে আসবে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url