ভাষা আন্দোলন রচনা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন
ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জন্য একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এই ভাষা আন্দোলন কে
কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে অনেক রচনা, অনেক প্রবন্ধ।ভাষা আন্দোলন রচনা প্রায়
পরীক্ষাতেই লিখতে আসে। তাই আমি ভাষা আন্দোলন রচনা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখার
চেষ্টা করেছি।
আমি আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করবো ভাষা আন্দোলন রচনা একটু বড় তাই
তোমরা অন্য রচনা কমন পেলে এই রচনাটি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে। তবে তোমাদের সব
রচনা মুখস্থ করে রাখতে হবে।ভাষা আন্দোলন রচনা সম্পর্কে বিস্তারিত নিচে আলোচনা করা
হলো-
পোস্ট সূচিপত্রঃ ভাষা আন্দোলন রচনা
- ভূমিকা
- ভাষা আন্দোলন
- ঐতিহাসিক মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ
- ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমি
- ২১ /একুশে ফেব্রুয়ারি
- ২১/একুশে ফেব্রুয়ারির পরবর্তী আন্দোলন
- ভাষা আন্দোলনও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন
- ভাষা আন্দোলনের অর্জন
- উপসংহার
ভাষা আন্দোলন রচনা
নিচে ভাষা আন্দোলন রচনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো
ভূমিকা
১৯৪৭ সালের তৎকালীন পূর্ব বাংলায় বর্তমানে বাংলাদেশ সংগঠিত হয় একটি রাজনৈতিক ও
সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বাংলা ভাষাকে ঘিরে মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে একটি আন্দোলন
শুরু হয় যাকে ভাষা আন্দোলন বলা হয়। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তদানীন্তন
পাকিস্তান অধীর রাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণ দাবির
বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করলেও এর বীজ রোপিত
হয়েছিল অনেক আগে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সালাম, বরকত, শফিক ও জব্বারসহ
আরো অনেকে বাংলা ভাষার দাবিতে শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা, রাষ্ট্রভাষার
স্বীকৃতি লাভ করে। পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র হলেও এর সমাজ ব্যবস্থায় কোন একক
যোগসূত্র ছিল না।
আরো পড়ুনঃ মোবাইল ফোন রচনা সম্পর্কে জেনে নিন
আর এর প্রধান কারণ ছিল দুই পাকিস্তান যথা - পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে
ভাষাগত পার্থক্য। আর এই কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের
সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারেনি। এরই সূত্র ধরে এদের মধ্যে শুরু হয় ভাষাগত
বিরোধ। প্রকৃত বিচারে আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে
উত্তরণের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
এই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন বাঙালি জাতীয়তা বোধের উন্মেষ ঘটে
অন্যদিকে তেমনি বাঙালি জাতি সমগ্র পরাধীনতা ছিন্ন করে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর
হয়।পরবর্তীতে এই ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বাংলার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের পরতে
পরতে দেখতে পাওয়া যায় এবং এর সার্থক পরিণতি হলো বর্তমানে দেশ স্বাধীন ও
সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ভাষা আন্দোলন
ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম
হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল দুইটি অংশে বিভক্ত যথা- পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব
বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবধান
ছিল প্রায় দুই ২০০০ হাজার কিলোমিটার বা ১২৪৩ মাইল প্রায়। আর এই অধিক দূরে
অবস্থানের কারণে দুই রাজ্যের মধ্যে ভৌগোলিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে
অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য ছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা .৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর
মাসে পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে অনুষ্ঠিত হয় একটি শীর্ষ সম্মেলন। এ সম্মেলনে
উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ
সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে প্রচন্ড প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩
শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের গণপরিষদের বৈঠকে উর্দু, ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা
ভাষাকে ব্যবহারের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
আরো পড়ুনঃ নিয়মানুবর্তিতা রচনা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন
আর এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন পূর্ব বাংলা থেকে নবনির্বাচিত সদস্য কুমিল্লার
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এ সংসদীয় প্রস্তাব গৃহীত হয়নি বরং
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এ প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করেন। বাংলা ভাষাকে
রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তমুদ্দিন মজলিস এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে।
১৯৪৮ সালের ১০ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বাংলা ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় বাংলা ভাষাকে
রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ই মার্চ ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১১ই মার্চ সেই ধর্মঘটে পিকেটিং এর সময় গ্রেফতার
করা হয়। এর কিছুদিন পর অর্থাৎ ২১ শে মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্না ঢাকায় আসেন এবং
ভাষণ দেন। আর এই ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র
রাষ্ট্রভাষা। আবার ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়ে তিনি একই
বক্তব্য রাখেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
তখন উপস্থিত ছাত্র-জনতা "না না" বলে এর প্রতিবাদ জানান। তারা দাবি করেন উর্দু নয়
বাংলায় হবে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে
জন্ম হয় গভীর ক্ষোভের। বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে এবং
কতিপয় দাবিতে নীতি গৃহীত হয় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করা হবে।
ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়
১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমু উদ্দিন
আবারো ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।এই ঘোষণার ফলে
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভ এ ফেটে পড়ে। এই ঘোষণার প্রতিবাদ স্বরূপ
সিদ্ধান্ত হয় যে ২৯ শে জানুয়ারি ঢাকা শহরে প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে।
ভাষার দাবিতে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে সমগ্র পূর্ব
বাংলার সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচি ও ধর্মঘটের আহ্বান করে। এই আন্দোলন দমন
করতে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে।এর ফলে সেই দিন অর্থাৎ একুশে ২১ শে ফেব্রুয়ারি
ঢাকা শহরে সমগ্র মিছিল - সমাবেশ নিষিদ্ধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানের
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভাষার দাবিকে বিনষ্ট করার জন্য দমন মূলক নীতির আশ্রয় গ্রহণ
করে।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের উৎসব রচনা সম্পর্কে জেনে নিন বিস্তারিত
এবং ভাষা আন্দোলনের সমর্থকদের জেলে আটক করে ফলে প্রতিবাদের ঝড় আরো প্রশস্ত হয়।
আটককৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের সকল শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানানো হয়। এর ফলে ভাষার দাবিতে দেশের
সর্বত্রই আন্দোলন আরো জোরালো হয় এবং পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আরো কঠোরভাবে
দমনমূলক নীতি গ্রহণ করতে উধ্যত হন।
ভাষা আন্দোলনের শেষ পর্যায়
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি
১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ১ জনসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা
হয় আর এই সংগ্রাম পরিষদের মূল উদ্দেশ্য ছিল -
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ ও
রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন কে আরো তীব্রতর করা
আর এই কমিটিতে আওয়ামী লীগ থেকে দুইজন ছাত্রলীগ থেকে দুই ২ জন, পূর্ব পাকিস্তানের
যুবলীগ থেকে দুই ২ জন এবং খিলাফত রব্বানী থেকে দুই ২ জন করে সদস্য নির্বাচিত করা
হয়। গোলাম মাহবুব এই কমিটির আহবায়ক ছিলেন। এই কমিটিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়
যে, একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা ও দেশব্যাপী হরতাল পালন করা।
ঐতিহাসিক মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন গভর্নর নুরুল আমিন সরকার উক্ত কর্মসূচি কে
বানচাল করার জন্য ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। কিন্তু ছাত্র-জনতা ভয় পায়নি বরং
তারা ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী অর্থাৎ সকাল ৯
টা থেকে সরকারি আদেশ অমান্য করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল - কলেজের হাজার হাজার
ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসে সমবেত হয়। পুরাতন কলাভবনের প্রাঙ্গণে আমতলায় ১৪৪
ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক ছাত্রসভা।
ছাত্ররা ৫৭ টি ছোট ছোট দলের বিভক্ত হয় এবং "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই"
স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে চাই কিন্তু পুলিশ অস্ত্র হাতে চারিদিকে ঘিরে
রাখে কিন্তু ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। সকল ছাত্র
একত্র হয়ে বেলা সোয়া ১১ টার দিকে সকল প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গে রাস্তায় নামার
প্রস্তুতি নিলে পুলিশ ছাত্রদের সতর্ক করে দেয় এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন পুলিশকে কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে
অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগের নির্দেশ দেন। উপাচার্যের এই
নির্দেশে ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগের সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে কয়েকজন
ছাত্রকে গ্রেফতার করলে সহিসতা আরো ছড়িয়ে পড়ে।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প রচনা সম্পর্কে বিস্তারিত
এছাড়াও আরো অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতা
বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ছাত্রদের এই মিছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি আসলে
পুলিশ ১৪৪ ধারা আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর গুলি বর্ষন করে আর এই গুলিতে শহীদ হন
সালাম, বরকত, রফিক, শফিক ও জব্বারসহ আরো অনেকে শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে
ওঠে।
সরকারের এই বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভের আগুন দাউ দাউ করে
জ্বলে ওঠে। ছাত্রদের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের জনগণ প্রতিবাদ মূখর হয়ে রাজপথে
নেমে আসে এবং প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলে।
ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমি
ভাষা আন্দোলন বাংলার জাতীয় ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ঘটনা এবং এই বীজ রোপিত
হয় দেশ বিভাগের পরেই। বাংলার অধিকাংশ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্বেও
উর্দুকে বাংলার মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয় যা ছিল সম্পূর্ণ
অগণতান্ত্রিক। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট এরই প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ
অধ্যাপক আবুল কাশেম এর নেতৃত্বে পহেলা সেপ্টেম্বর ৩ সদস্য বিশিষ্ট মজলিস গঠন করা
হয়।
আর এই মজলিস গঠিত হয়েছিল দেশ বিভাগের মাত্র ১৭ দিন পরে। আর এর সংগঠনের সহযোগী
সদস্য ছিলেন আব্দুল গফুর, অধ্যাপক এ এস এম নুরুল হক ভূঁইয়া, দেওয়ান মোহাম্মদ
প্রমুখ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ছিল এই সংগঠনের সূচনা লগ্ন থেকে মূল
উদ্দেশ্য। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসকগোষ্ঠী এ দাবি
মেনে নিতে পারেননি।
প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনের জন্মই হয়েছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর একতরফাভাবে
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার কারণেই। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী
উর্দু কেই একমাত্র রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণ করতে সচেষ্ট হন কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে
উর্দু ভাষা ভাসির লোক ছিল অনেক নগণ্য।
২১ /একুশে ফেব্রুয়ারি
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী অর্থাৎ এ দিন সকাল ৯
টা থেকে বিভিন্ন স্কুল কলেজে ছাত্ররা আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এবং তারা
১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং একই সাথে তারা পূর্ব বাংলার
মানুষের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের ক্ষমতাকে বিবেচনা করার আহ্বান করতে থাকে।
পুলিশ অস্ত্র হাতে ছাত্রদের চারিদিক থেকে ঘিরে রাখে এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দিন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া বেলা সোয়া ১১ টার দিকে গেটে জড়ো হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গে রাস্তায় নামার
প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না
করতে সতর্ক করে দেয়। কিন্তু কিছু ছাত্র দৌড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে চলে গেলে
ও বাদবাকি ছাত্ররা পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেতে
বাধ্য হয়।
আরো পড়ুনঃ দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান রচনা জেনে নিন
তখন তারা পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন পুলিশকে
কাদানো গ্যাস নিক্ষেপ না করার জন্য অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়
প্রাঙ্গণ ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। উপাচার্যের এই নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ত্যাগ করতে চাইলে কয়েকজন ছাত্রকে ১৪৪ ধারা জারি ভঙ্গের অপরাধে গ্রেফতার করা হয়।
এর ফলে সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়ে অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে
আবার ছেড়ে দেওয়া হয়।
আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্ররা আরো জোরালো আন্দোলন শুরু করে। ওই দিন অর্থাৎ
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি দুপুর ২ টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইন সভায় যোগ
দিতে ছাত্ররা তাদের বাধা দেয় এবং কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেই যে তারা আইন সভায়
গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবেন। ছাত্ররা আইন সভার দিকে রওনা হলে পুলিশ দৌড়ে আসে
এবং বেলা তিন ৩ টার দিকে ছাত্রাবাসে গুলি বর্ষন শুরু করে।
পুলিশের গুলি বর্ষণে রফিক উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল জব্বার, সালাম, বরকত, রফিকসহ
অনেকেই ঘটনা স্থলে শহীদ হন।এছাড়াও অলিউল্লাহ নামের আট ৮-৯ নয় বছরের একজন কিশোর
ও নিহত হয়। ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে ছাত্ররা ঘটনাস্থলে আসার
উদ্যোগ নেয়। মুহূর্তের মধ্যেই দোকান, অফিস সবকিছু বন্ধ হয়ে যায় এবং ছাত্রদের
আন্দোলন সাধারণ মানুষের আন্দোলনের রূপ নেয়।
পুলিশের গুলির খবর পেয়ে মাওলানা তর্কা বাগিস বিরোধীদলীয় বেশ কয়েকজন বিক্ষুব্ধ
ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ায়। এবং ওই সময় গণপরিষদের অধিবেশনের প্রস্তুতি
চলছিল। গণপরিষদের ক্রান্ত কুমার দাস, মনোরঞ্জনধর শরমা, আহমেদ ও
ধীরেন্দ্রনাথ সহ মুখ্যমন্ত্রী
নুরুল আমিনকে অধিবেশন স্থগিত করতে অনুরোধ করেন। এবং হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে
যেতে এবং অনুরোধ করেন। কিন্তু নুরুল আমিনে অনুরোধ রাখেনি এবং অধিবেশনে বাংলা
ভাষার বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন।
২১/একুশে ফেব্রুয়ারির পরবর্তী আন্দোলন
একু ২১ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে
ওঠে। ২২ ও ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র - শিক্ষক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক ও
সাধারণ জনগণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পূর্ণ হরতাল পালন করে। .২২শে ফেব্রুয়ারি শফিউর
রহমান শফিক শহীদ হন। ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র জনতার মিছিলে ও পুলিশ
নির্যাতন চালায়। শহীদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে ছাত্ররা ঐদিন ঢাকা মেডিকেল
কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করেন।
২৪ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন ২২ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ শফিউর
রহমানের বাবা। আবার ২৬ শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক শহীদ মিনারটি
আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
ভাষা আন্দোলনও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলার আপামার জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজ তাদের বুকের
তাজা রক্তের বিনিময়ে যে মাতৃভাষা অর্জন করেছে তা এখন আর শুধু দেশের মধ্যে
সীমাবদ্ধ নেই। বরং তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। ভাষার জন্য বাঙালি জাতির যে
ত্যাগ তা ভাবতে শিখিয়েছে পুরো বিশ্বকে। .১৯৯৯ সালের ১৭নভেম্বর জাতিসংঘের
শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষা
দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।
বিশ্বের মানুষ আজ বাঙ্গালীদের মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের সাথে একাত্মতা ঘোষণা
করেছে। সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ আরো অনেকের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত
হয়েছে আজকের এই বাংলা ভাষা। মাতৃভাষা দিবস পালনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়
ইউনেস্কোর গ্রহিত প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে এবং সেখানে বলা হয় যে, সংস্কৃতিক ও
ঐতিহ্যের সংরক্ষণের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হল ভাষা।
মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত প্রচলন বা বৈচিত্রকে বা বহু ভাষাভাষিকে
উৎসাহিত করে না ,তা ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়নের
অনুধাবনের ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। একু ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করেছে বাংলাদেশ সহ জাতিসংঘ ভুক্ত প্রায় ১৯৩ টি
দেশ। বাংলা ভাষা বাঙালি জাতির জন্য অজস্র মর্যাদার প্রতীক।
ভাষা আন্দোলনের অর্জন
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি যে আন্দোলন তা বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার আন্দোলন
হলেও এই আন্দোলন বাঙালি জাতিকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। আর এর ফল
হিসাবে
১৯৫৬ সালে বাংলা ও উদ্যোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা
হয়
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর বাংলা ভাষাকে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি প্রদান করা
হয়
২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা করা
হয়
আর এই স্বীকৃতি প্রদানের জন্য যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারা হলেন কানাডা
প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম।
উপসংহার
পরিশেষে আমরা এ কথা বলতে পারি যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে
তাদের উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তুলতেই প্রথমেই আঘাত হানে তা বাংলা ভাষার প্রতি।
আর ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বাঙালি জাতির সর্বপ্রথম পাকিস্তানি
শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন। ভাষা আন্দোলন সংগ্রামের উদ্বুদ্ধ
হয়ে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়।
ভাষার জন্য বাংলা মায়ের সন্তানেরা যে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত
করেছেন তাদের আত্মত্যাগ বাংলার মাটিতে অম্লান হয়ে থাকবে। তাদের আত্মত্যাগের
ফলে অর্জিত এই বাংলা ভাষায় এখন আর বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বাংলা ভাষা
এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বে।
বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাঙালি
জাতির বিজয় বাংলার শহীদদের আত্মত্যাগের ফলেই আমরা আজ বাংলা ভাষাকে নিয়ে
গর্ববোধ করি।
মায়ের ভাষা।