৭ই মার্চের ভাষণ - ৭ই মার্চের ভাষণের ৪ দফা জেনে নিন
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণ ভাষণ প্রদান করেন এবং তিনি ৭ই
মার্চের ভাষণের ৪ দফা দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু এই ৭ই মার্চের ভাষণ -
৭ই মার্চের ভাষণের ৪ দফা এখনো আমাদের অনেকের কাছে অজানা বিষয়। আমি
আজকে ৭ই মার্চের ভাষণ - ৭ই মার্চের ভাষণের ৪ দফা আমার আর্টিকেলের
মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
১৯৭১ সালে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন ইউনেস্কো তা
স্বীকৃতি দান করেন। এই ঐতিহাসিক ভাষণকে ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর
"বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য" বা "ডকুমেন্টারি হেরিটেজ" হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন।
নিচে ৭ই মার্চের ভাষণ - ৭ই মার্চের ভাষণের ৪ দফা নিয়ে বিস্তারিত
আলোচনা করা হলো।
পোস্ট সূচিপত্রঃ ৭ই মার্চের ভাষণ - ৭ই মার্চের ভাষণের ৪ দফা
৭ ই মার্চের ভাষণের বৈশিষ্ট্য
- ঐতিহাসিক ভাষণের কারণ
- ৭ ই মার্চের ভাষণ
৭ই মার্চের ভাষণের বিষয়বস্তু কয়টি ছিল
৭ ই মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি
- ৭ই মার্চের ভাষণের ৪ দফা
- শেষ বক্তব্য
৭ ই মার্চের ভাষণের বৈশিষ্ট্য
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সোহরার্দী উদ্যান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি
দিয়েছিলেন। জাতি সত্তা বিনির্মাণে ও জাতীয় জাগরনকে জাগিয়ে তুলতে পৃথিবীর অনেক
দেশে অনেক সময় ভাষণের ভূমিকার প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে। সেদিন
ময়দানে উপস্থিত ১0 লক্ষ বাঙালি, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেশিনগান, বন্দুক,
কামানের হুমকির মুখে ঘোষণা করেন -" এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"।
দেশ গঠনের প্রশ্নে, জাতির মুক্তির প্রশ্নে, এমনকি স্বাধীনতার প্রশ্নেও রাষ্ট্রীয়
কর্মকর্তা ও নেতাদের ভাষণের প্রভাব অপরিসীম। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন
দাসপ্রথা উচ্ছেদার্থে রক্তাক্ত গৃহেযুদ্ধের পরে সাম্য ও স্বাধীনতা
প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শহীদের সম্মানে ২৭২ শব্দের তিন মিনিটের ভাষণ
দিয়েছিলেন।বিশ্বের দরবারে আজও সেই ভাষণটি অন্যতম ভাষণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছে ।
তেমনি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতার আহ্বান
জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বর্তমান
সোহরার্দী উদ্যানে যে ভাষণটি প্রদান করেছিলেন তার স্থায়িত্ব ছিল ১৮ মিনিট।
সেদিনের সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি এখন অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
আরো পড়ুনঃ
বিজয় দিবস কি ও কেন জেনে নিন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাত (৭) ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি বাঙালি জাতির
গৌরবের ঐতিহ্য ও সমাদিত হলেও এখন তা বিশ্বের দরবারে সমাদিত ও স্বীকৃত। ১৯১৭ সালের
৩১ শে অক্টোবর ঐতিহাসিক এই ভাষণ টিকে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান সংস্থা
(ইউনেস্কো) কর্তৃক বিশ্বের অন্যতম ঐতিহাসিক
দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আর ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতির মাধ্যমে ভাষণটি
এখন বিশ্বের দরবারে গৌরবময় ঐতিহ্যের সম্পদ হিসেবে পরিণত হয়েছে।
ঐতিহাসিক ভাষণের কারণ
বাঙালি জাতীর আন্দোলনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল আইয়ুব আলী খান
পদত্যাগ করেন। এরপর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন ইয়াহিয়া খান। তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
হয়ে বাঙালি জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে নির্বাচনের আয়োজন করেন । ১৯৭০ সালের ৭ই
ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর
রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কু সংখ্যা গরিষ্ঠতা গরিষ্ঠতা লাভ করে।
১৯৭০ সালের ৭ ই ডিসেম্বর নির্বাচনে জনসংখ্যার অনুপাতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ১৬৯
টি, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জন্য ১৮ টি, বেলুস্থান প্রদেশের জন্য ৪ টি
,পাঞ্জাব প্রদেশের জন্য ৮২ টি, সিন্ধু প্রদেশের জন্য ২৭ টি আসন নির্ধারণ করা হয়।
২৯৩ আসন ছিল সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সদস্যদের জন্য।আর এর সাথে ৭টি আসন
যুক্ত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের উপজাতি অঞ্চলের জন্য। আর ১৩ টি আসন ছিল পরোক্ষভাবে
নির্বাচিত মহিলাদের জন্য।
১৯৭০ সালের ৭ ই ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানেরর ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭
আসন পায় আওয়ামী লীগ এবং পিডিবি পায় বাকি দুইটি আসন। ১৩ টি মহিলা
আসনের মধ্যে ৭ টি আসন পায় মহিলা আওয়ামী লীগ।৩১৩ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি
আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। সেই সময় সারা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো
একসাথে হয়েও আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে পারেনি।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙ্গালীদের এ বিজয় দেখে হতবাক হয়ে যায।মামুন মুনতাসির,
পাকিস্তানি জেনারেলদের মন, ঢাকা, সময় প্রকাশনা, ২০১১ তৃতীয় মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ২৮৬
- থেকে পাওয়া - পাক গোয়েন্দাদের ধারণা ছিল, "মুজিব ৩৭% আসন জিতবেন, ভাষানী ও
প্রায় কাছাকাছি থাকবেন আর বাকি ২৫ ভাগ ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভাগ হয়ে
যাবে"।
কিন্তু বাস্তবে হয় সম্পূর্ণ তার উল্টো আর এটা দেখে তারা হতবাক হয়ে পড়ে। এরপর
শুরু হয় বাঙ্গালীদের ক্ষমতা হস্তান্ত না করার ষড়যন্ত্র। তারা ভাবতে শুরু করে
যে, এমন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেলে তারা চিরতরে তাদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে আর
পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের সাথে যোগ দেয় উচ্চাভিলাসী ভুট্টো খান। আর তখন
থেকে জাতীয় অধিবেশন নিয়ে নানান তাল বাহানা শুরু হয়।
১ মার্চ
পাকিস্তানের তদানীতন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এই দিন ভাষণ দেয়ার কথা ছিল।
তাই তার ভাষণ শোনার জন্য সারা দেশের লোক টেলিভিশন ও রেডিও খুলে বসেছিল। কিন্তু
তিনি কোন বক্তব্য পেশ করেননি। ইয়াহিয়া খানের পরিবর্তে অন্য একজন এসে ঘোষনা করলো
- " পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের
অধিবেশন বাতিল করেছেন, তিনি বর্তমান পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক
সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছেন"।
আরো পড়ুনঃ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস কেন পালন করা হয় জেনে
নিন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বঙ্গবন্ধু মুক্তির ডাক
দিলেন বাঙালি জাতির জন্য। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন,- এটা কোন গণতন্ত্র নয়
এটি স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকদের মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আমরা পূর্ব
পাকিস্তানের বাঙালিরা ঘৃণা করে এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করলাম এবং সারা দেশব্যাপী
বাংলা সাধারণ মানুষ ২ এবং ৩ মার্চ হরতাল পালন করবে। আর .৭ মার্চ পর্যন্ত পরবর্তী
নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করুন"।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য স্বাধীনতার শ্লোগান ছিল,- "বীর বাঙালি
অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর"। আর এ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় এবং স্বাধীন
বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো।
২ মার্চ
এই দিন পুরো ঢাকা শহর ছিল হরতাল মিছিল এবং কারফিউ এর নগরী। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ছিল সেদিনের প্রধান হাইলাইটস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল থেকে মিছিল ছিল আর এই মিছিলের বিস্তার ছিল
নিউমার্কেটের মোড় থেকে নীলক্ষেতের সড়ক দিয়ে পাবলিক লাইব্রেরী পর্যন্ত।
এত বিশাল সমাবেশ কেউ কখনো দেখেনি। এই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম গেটের
বটতলায় ডাক সু ভিপি আব্দুর রব বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বিশাল সমাবেশে রোড
ও লাঠি মিছিল করে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। এই দিন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়
হলোবাঙালির মুখ থেকে পাকিস্তান কথাটি একরকম বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সন্ধ্যায় এক কনফারেন্সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবার "বাংলাদেশ" কথাটি
উচ্চারণ করেন। সেই দিন হরতাল ঠেকাতে মাঠে নামে পাক হানাদার বাহিনী। প্রায় ৫০
জনের মতো গুলি বৃদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। যারা গুলিবিদ্ধ হয়
তাদের অধিকাংশই ছিল ঢাকা তেজগাঁও এলাকার। ঢাকা তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুল এন্ড
কলেজের ছাত্র মামুন ও আজিজ মোর্শেদ গুলিবিদ্ধ হয় এবং তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজে
আনার পর আজিজ মোর্শেদ মারা যান।
সারা ঢাকা শহর সেই দিন কারফিউ জারি করা হয় এবং ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। পরবর্তী
নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল সাত (৭) টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা
পর্যন্ত হরতাল চলবে এই নির্দেশনা ও দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলন করেন এবং এই সংবাদ সম্মেলনে নিরস্ত্র মানুষের ওপর
গুলি বর্ষণের তীব্র নিন্দা জানান।
বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে অর্থ দিবস অর্থাৎ ভোর ৬
টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত হরতালের ডাক দেন এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে
বৈঠক শেষে পল্টন ময়দানে এক সমাবেশের ঘোষণা দেন।
৩ মার্চ
এই দিন নিহতদের স্মরণে শোক দিবস পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পল্টন
ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিকলীগের সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন। সেখানে আবেগ জড়িত
কন্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন,"আমি থাকি আর না থাকি বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলন যেন থেমে
না থাকে। বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি না থাকলে আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব
দিবেন, তাদেরও যদি হত্যা করা হয় যিনি জীবিত থাকবেন তিনিই নেতৃত্ব দিবেন।
যে কোন মূল্যে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে"। এরপর
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রবিবার রেসকোর্স ময়দানে পরবর্তী কর্মপন্থা ঘোষণা করেন।
৪ মার্চ
১৯৭১ সালের ৪ মার্চ ছিল গণবিক্ষোভে টলমল। যত দিন যাচ্ছিল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা
যেন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই দিন ১৪৪ ধারা জারি ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে আসে হাজার
হাজার মানুষ।।এই দিন খুলনায় বাঙালি ও অবাঙ্গালীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ঠিক এই
দিনে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সভায় হরতাল দমনে নিপীড়নের জন্য নিন্দা জ্ঞাপন করা
হয়। লাগাতার হরতালের কারণে ঢাকা সহ সারা দেশ প্রায় অচল হয়ে পড়ে।
পূর্ব পাকিস্তানের মহিলা পরিষদের নেত্রী ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল ও মালেকা বেগম
এলাকায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানানো হয়।এই দিনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ
ঘটনা ঘটে আর তা হল "রেডিও পাকিস্তান ঢাকা"র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় "ঢাকা
বেতার কেন্দ্র" আর সেই দিনের আন্দোলন থেকেই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়
আন্দোলনে নতুন মুক্তির পথে।
৬ মার্চ
পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের সাথে ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন। ৬ ই মার্চ আরো ঘোষণা করা হয় যে,
২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। পশ্চিম পাকিস্তান সরকার
পরিস্থিতির চাপে ভীত সশস্ত্র হয়ে পড়ে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সদর দপ্তর
থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেন কোনোভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা না দেয়া হয়।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের মধ্যে পার্থক্য জেনে নিন
৭ই মার্চের জনসভা কে কেন্দ্র করে বসানো হয় কামান এবং বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র
সজ্জিত করে রাখা হয়। মেজর সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে লিখেছেন যে,৭ ই
মার্চের জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের জি ও সি আওয়ামী লীগ নেতাকে স্পষ্ট জানিয়ে
দেন, "পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোন কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবেলা করা
হবে। বাঙ্গালীদের হত্যার জন্য মেশিনগান, কামান, ট্যাংক সহ সবকিছুই প্রস্তুত রাখা
হবে।
প্রয়োজন হলে ঢাকা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না
কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না"।
৭ ই মার্চের ভাষণ
"ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভরা ক্লান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।
আপনারা সবাই জানেন এবং বোঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের
বিষয় আজ ঢাকা-চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ
রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চাই, বাংলার মানুষ বাঁচতে চাই, বাংলার
মানুষ অধিকার চাই।
আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়
পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করলাম ১৫ই ফেব্রুয়ারি
তারিখ থেকে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দিন।তিনি আমার কথা রাখলেন না তিনি
রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।
তিনি বললেন প্রথম এসেম্বলি মার্চ মাসে হবে আমরা বললাম ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে
বসবো, আমি বললাম এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব।এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম যদি কেউ
ন্যায্য কথা বলে আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা
মেনে নেব।
ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন, আমি বললাম যে আমি
যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে
আসলেন তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো ।দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ
দেওয়া হলো আমাকে, অ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়ার পরে দেশের মানুষ
প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো।
কি পেলাম আমরা ! যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহি শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে
রক্ষা করার জন্য। আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব - দুঃখী -
নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের ওপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের
সংখ্যাগুরু আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের ওপর
ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম জেনারেল ইয়াহিয়া খান
সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দেখে যান কিভাবে আমার গরিবের উপর, আমার
বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা
হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি
বললেন আমি নাকি স্বীকার করেছি ১০ তারিখ গোল টেবিল বৈঠক হবে।
আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি কিসের গোল টেবিল বৈঠক কার সঙ্গে বসবো যারা আমার
মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছেন তাদের সঙ্গে বসবো হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে ৫
ঘন্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন সমস্ত দোষ তিনি আমার উপর দিয়েছেন।
বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন।
ভাইয়েরা আমার, ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করা হয়েছে। রক্তের দাগ শুকাই নাই আমি দশ
তারিখে বলে দিয়েছি যে ওই শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান
যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলি কাল করেছে কল করেছে আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম
সামরিক আইন বন্ধ করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত যেতে
হবে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে,
আর জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা
করে দেখব আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে
আমরা পারবো না।
আমি প্রধানমন্ত্রী তো চাই না আমার এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার
অক্ষরে বলে দিতে চাই যে আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট, কাচারি, আদালত, শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। রিক্সা ও ঘোড়ার গাড়ি, রেল
চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট সহ গভমেন্ট
দফতরগুলো কোন কিছু চলবে ।
আরো পড়ুনঃ
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম ও পেশা সহ কোন বিভাগে কতজন জেনে নিন
২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয় আর
যদি আমার লোকের উপর একটা গুলিও এবং আমার লোককে হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে
অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে
শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি
তোমরা তা বন্ধ করে দেবে।
আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো, তোমরা আমার ভাই। তোমরা চলতে থাকো কেউ
তোমাদের কিছু বলবেনা। কিন্তু আর আমার লোকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ৭
কোটি মানুষকে দাবায় রাখতে পারবে না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের
দাবায়ে রাখতে পারবেনা।
৭ই মার্চের ভাষণের বিষয়বস্তু কয়টি ছিল
- সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা
- সামরিক আইন প্রত্যাহার প্রত্যাহারের দাবি জানানো
- পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিকদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত
- অত্যাচার ও সামরিক আগ্রাসন মোকাবেলার জন্য বাঙ্গালীদের আহ্বান জানানো
নিগ্রহ ও আক্রমণ প্রতিরোধের আহ্বান এবং বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত
করা
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক হরতাল চালিয়ে
যাওয়ার সিদ্ধান্ত প্রদান
৭ ই মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি
১৯৭১ সালে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন ইউনেস্কো তা
স্বীকৃতি দান করেন। এই ঐতিহাসিক ভাষণকে ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর
"বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য" বা "ডকুমেন্টারি হেরিটেজ" হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন। এই
ভাষণটি সহ মোট ৭৭ টি গুরুত্বপূর্ণ নথিকে একই সাথে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পুরো
বিশ্বে যত গুরুত্বপূর্ণ দলিল রয়েছে ইউনেস্কোতা সংরক্ষণ করে রেখেছে।
"মেমরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার" এ ৭ ই মার্চের ভাষণ নথি
ভুক্ত রয়েছে। এই "মেমোরি অফ দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার" এ এখন
পর্যন্ত ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ ভাষন নথিভুক্ত হয়েছে। ৭ই মার্চের ভাষণ এ গুলোর মধ্যে
অন্যতম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বেশ কিছুদিন এই ভাষণ নিষিদ্ধ ছিল যার কারণে
প্রধানমন্ত্রী "শেখ হাসিনা" এই ভাষণকে ইতিহাসের প্রতিশোধ হিসেবে আখ্যায়িত
করেছেন।
ডক্টর জাফর ইকবাল যিনি শাবি প্রবীর শিক্ষক তিনি বলেন, এই ভাষণটিকে স্বীকৃতি দিয়ে
ইউনেস্কো সম্মানিত হয়েছে, কারণ এখন তারা বলতে পারবে যে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি
তাদের কাছে সংরক্ষিত আছে।
৭ই মার্চের ভাষণের ৪ দফা
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩ টা ২০ মিনিটে ঐতিহাসিক
রেসকোর্স ময়দানে বর্তমান সোহরার্দী উদ্যানে উপস্থিত হন। ৭ ই মার্চের
ভাষণকে বলা হয় বাঙালির জাতির মুক্তির সনদ। ১০ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে রেসকোর্স
ময়দান ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ ই মার্চের ভাষণে
চারটি বিষয় উপস্থাপন করেন। আর এগুলোকেই .৪ দফা দাবি বলে অভিহিত করা হয়।
এই ৪ দফা দাবি গুলো হল-
(১) চলমান সামরিক আইন প্রত্যাহার
(২) সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া
(৩) গণহত্যা তদন্ত করা
(৪) নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ প্রকাশ
পেয়েছে এবং ইউনেস্কোর মেমরি অফ দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল ১৯৭১ সালের ৭ ই
মার্চের ভাষণ বিশ্ব কামানো ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করেছে
শেষ বক্তব্য
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাত (৭) ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি বাঙালি জাতির
গৌরবের ঐতিহ্য ও সমাদিত হলেও এখন তা বিশ্বের দরবারে সমাদিত ও স্বীকৃত। ১৯১৭ সালের
৩১ শে অক্টোবর ঐতিহাসিক এই ভাষণ টিকে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান সংস্থা
(ইউনেস্কো) কর্তৃক বিশ্বের অন্যতম ঐতিহাসিক
দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আর ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতির মাধ্যমে ভাষণটি
এখন বিশ্বের দরবারে গৌরবময় ঐতিহ্যের সম্পদ হিসেবে পরিণত হয়েছে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url